
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আরো কয়েকটি দেশের বিনিয়োগে দেশে গড়ে উঠতে যাচ্ছে একাধিক বিশ্বমানের হাসপাতাল। প্রাথমিকভাবে চীনের বিনিয়োগে এক হাজার শয্যার তিনটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যার একটি ঢাকার বাইরে, একটি চট্টগ্রামে ও আরেকটি দেশের উত্তরাঞ্চলে নির্মিত হবে বলে জানা গেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের আশা, বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে উঠতে যাওয়া এসব বিশ্বমানের হাসপাতাল কেবল চিকিৎসা সেবার উন্নয়নই করবে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এতে রোগীদের বিদেশমুখিতা যেমন কমবে, তেমনি দেশের বাইরের রোগীদের বাংলাদেশে আসতে আকৃষ্ট করার মতো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্বাস্থ্য গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। রোগী আসবে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চীনের একটি রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল প্রকল্প উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে যৌথভাবে হাসপাতাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানিও হাসপাতাল নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বর্তমানে বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানের ‘মাল্টি-সুপার স্পেশালিটি সেন্টার’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে যেখানে ক্যান্সার, হৃদরোগ, নিউরোলজি, অর্থোপেডিকস, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টসহ প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা থাকবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত ব্যাপক পরিবর্তন দেখার পর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে একদিকে যেমন বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে, তেমনি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে ওঠা হাসপাতালগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নত করা। সাধারণত এসব হাসপাতাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি অনুসরণ করে কাজ করে, যা সাধারণ হাসপাতালগুলোর তুলনায় অনেক উন্নত।’তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে চলে যান, তাদের অধিকাংশই ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টসহ বেশকিছু জটিল রোগে আক্রান্ত। আমরা যদি বিশ্বমানের প্রযুক্তিকে যুক্ত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা দিতে পারি, তাহলে এসব রোগী আর বিদেশমুখী হবেন না। যতটুকু জেনেছি, আমরা সেই পরিকল্পনা নিয়েই সামনের দিকে এগোচ্ছি।’
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিতব্য বিশ্বমানের হাসপাতালগুলো যে শুধু আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির কেন্দ্র হবে তা নয়, বরং এগুলো দেশে কর্মসংস্থানেরও বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ এক হাজার শয্যার হাসপাতাল পরিচালনায় আনুমানিক ১৫০০ থেকে ২০০০ জন দক্ষ জনবল প্রয়োজন হতে পারে। জনবল কাঠামো নির্ভর করে হাসপাতালের ধরন, প্রযুক্তির পরিমাণ, সেবার পরিধি এবং ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সুবিধা চালু রাখার সক্ষমতার ওপর। এক্ষেত্রে যদি এ ধরনের একাধিক হাসপাতাল নির্মাণ সম্ভব হয়, তাহলে নতুন করে স্বাস্থ্য খাতে অন্তত আরও ৬ থেকে ৭ হাজার চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট চিকিৎসক রিনা চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের বড় হাসপাতালগুলো নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের মতো চিকিৎসকদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি হবে। এখানে কাজ করার মাধ্যমে আমরা শুধু উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হব না, বরং নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করব।’নুসরাত জাহান নামের এক নার্সিং শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে উঠলে আমাদের মতো নার্সদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। আমরা শুধু কাজের সুযোগই পাব না, বরং উন্নত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারব, যা আমাদের পেশাগত দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ শুধু হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নয়, বরং এ বিনিয়োগের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগও সম্ভব হবে। এটির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের গুণগত মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া এ বিনিয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। তাদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগে হাসপাতাল নির্মাণ শুধু স্বাস্থ্য সুবিধাই দেবে না বরং এটি আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বড় অবদান রাখবে। উন্নত প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা থেকে দেশীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা শিখতে পারবেন এবং তাদের নিজস্ব দক্ষতা বাড়াতে পারবেন।
এ বিষয়ে ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘নতুন হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, যা দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। এছাড়া এ ধরনের হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতিযোগিতামূলক মানও বৃদ্ধি পাবে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে চিকিৎসকরা প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবেন, যা তাদের দক্ষতার উন্নয়নে সহায়ক হবে।’তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসকরা বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসার প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। ফলে তারা নতুন পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবেন, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে।’
দেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো হেলথ ট্যুরিজম। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যদি বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে ওঠে তাহলে ভারত, নেপাল, ভুটান ও অন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশে আসবেন। ফলে শুধু দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হবে না বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘চীনের বিনিয়োগে যদি তিনটি বিশ্বমানের হাসপাতাল দেশের তিনটি প্রান্তে গড়ে ওঠে তাহলে শুধু ঢাকা শহরই নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও উন্নত চিকিৎসা সেবা পৌঁছাবে। এতে শুধু রোগীদের সুবিধা হবে না বরং বাংলাদেশের জন্য এটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।’বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হওয়ার পেছনে বড় ব্যবসায়িক দিকও রয়েছে বলে মনে করেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে একটি বড় ব্যবসায়িক দিকও রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে সেবা দেবে। তবে, জনগণকে সেবার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দিতে হবে এবং তা কতটা সহনীয় হবে, তা সরকারকে দেখতে হবে।’ডা. আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সরকার সেবার মান বজায় রেখে এবং মানুষের আর্থিক সক্ষমতার দিকে খেয়াল রেখে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি স্বাস্থ্য খাতের প্রতিযোগিতামূলক মান বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অবস্থানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। ২৫ বছর পর এসব হাসপাতালের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে, যেখানে উন্নত চিকিৎসা ও প্রযুক্তির সুবিধা আরও সহজলভ্য হবে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে খান আজাদ সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়নে হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে একদিকে রোগীদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে, অপরদিকে দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশ্বমানের প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম প্রবেশ করবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তনশীল একটি প্রক্রিয়া। বর্তমানে যেসব সুবিধা ও প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি, তা আগামী ২৫ বছর পর আরও উন্নত হবে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে একপর্যায়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা খাতে শক্তিশালী দেশে পরিণত হবে। এ কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আপডেট করার জন্য, আধুনিক প্রযুক্তির জন্য একটি সঠিক পরিকল্পনা থাকা জরুরি।’
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন
তাদের আশা, বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে উঠতে যাওয়া এসব বিশ্বমানের হাসপাতাল কেবল চিকিৎসা সেবার উন্নয়নই করবে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এতে রোগীদের বিদেশমুখিতা যেমন কমবে, তেমনি দেশের বাইরের রোগীদের বাংলাদেশে আসতে আকৃষ্ট করার মতো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্বাস্থ্য গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। রোগী আসবে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চীনের একটি রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল প্রকল্প উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে যৌথভাবে হাসপাতাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানিও হাসপাতাল নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বর্তমানে বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানের ‘মাল্টি-সুপার স্পেশালিটি সেন্টার’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে যেখানে ক্যান্সার, হৃদরোগ, নিউরোলজি, অর্থোপেডিকস, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টসহ প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা থাকবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত ব্যাপক পরিবর্তন দেখার পর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে একদিকে যেমন বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে, তেমনি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে ওঠা হাসপাতালগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নত করা। সাধারণত এসব হাসপাতাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি অনুসরণ করে কাজ করে, যা সাধারণ হাসপাতালগুলোর তুলনায় অনেক উন্নত।’তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে চলে যান, তাদের অধিকাংশই ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টসহ বেশকিছু জটিল রোগে আক্রান্ত। আমরা যদি বিশ্বমানের প্রযুক্তিকে যুক্ত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা দিতে পারি, তাহলে এসব রোগী আর বিদেশমুখী হবেন না। যতটুকু জেনেছি, আমরা সেই পরিকল্পনা নিয়েই সামনের দিকে এগোচ্ছি।’
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিতব্য বিশ্বমানের হাসপাতালগুলো যে শুধু আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির কেন্দ্র হবে তা নয়, বরং এগুলো দেশে কর্মসংস্থানেরও বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ এক হাজার শয্যার হাসপাতাল পরিচালনায় আনুমানিক ১৫০০ থেকে ২০০০ জন দক্ষ জনবল প্রয়োজন হতে পারে। জনবল কাঠামো নির্ভর করে হাসপাতালের ধরন, প্রযুক্তির পরিমাণ, সেবার পরিধি এবং ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সুবিধা চালু রাখার সক্ষমতার ওপর। এক্ষেত্রে যদি এ ধরনের একাধিক হাসপাতাল নির্মাণ সম্ভব হয়, তাহলে নতুন করে স্বাস্থ্য খাতে অন্তত আরও ৬ থেকে ৭ হাজার চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট চিকিৎসক রিনা চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের বড় হাসপাতালগুলো নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের মতো চিকিৎসকদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি হবে। এখানে কাজ করার মাধ্যমে আমরা শুধু উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হব না, বরং নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করব।’নুসরাত জাহান নামের এক নার্সিং শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে উঠলে আমাদের মতো নার্সদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। আমরা শুধু কাজের সুযোগই পাব না, বরং উন্নত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারব, যা আমাদের পেশাগত দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ শুধু হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নয়, বরং এ বিনিয়োগের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগও সম্ভব হবে। এটির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের গুণগত মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া এ বিনিয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। তাদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগে হাসপাতাল নির্মাণ শুধু স্বাস্থ্য সুবিধাই দেবে না বরং এটি আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বড় অবদান রাখবে। উন্নত প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা থেকে দেশীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা শিখতে পারবেন এবং তাদের নিজস্ব দক্ষতা বাড়াতে পারবেন।
এ বিষয়ে ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘নতুন হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, যা দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। এছাড়া এ ধরনের হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতিযোগিতামূলক মানও বৃদ্ধি পাবে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে চিকিৎসকরা প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবেন, যা তাদের দক্ষতার উন্নয়নে সহায়ক হবে।’তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসকরা বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসার প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। ফলে তারা নতুন পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবেন, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে।’
দেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো হেলথ ট্যুরিজম। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যদি বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে ওঠে তাহলে ভারত, নেপাল, ভুটান ও অন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশে আসবেন। ফলে শুধু দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হবে না বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘চীনের বিনিয়োগে যদি তিনটি বিশ্বমানের হাসপাতাল দেশের তিনটি প্রান্তে গড়ে ওঠে তাহলে শুধু ঢাকা শহরই নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও উন্নত চিকিৎসা সেবা পৌঁছাবে। এতে শুধু রোগীদের সুবিধা হবে না বরং বাংলাদেশের জন্য এটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।’বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হওয়ার পেছনে বড় ব্যবসায়িক দিকও রয়েছে বলে মনে করেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে একটি বড় ব্যবসায়িক দিকও রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে সেবা দেবে। তবে, জনগণকে সেবার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দিতে হবে এবং তা কতটা সহনীয় হবে, তা সরকারকে দেখতে হবে।’ডা. আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সরকার সেবার মান বজায় রেখে এবং মানুষের আর্থিক সক্ষমতার দিকে খেয়াল রেখে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি স্বাস্থ্য খাতের প্রতিযোগিতামূলক মান বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অবস্থানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। ২৫ বছর পর এসব হাসপাতালের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে, যেখানে উন্নত চিকিৎসা ও প্রযুক্তির সুবিধা আরও সহজলভ্য হবে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে খান আজাদ সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়নে হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে একদিকে রোগীদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে, অপরদিকে দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশ্বমানের প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম প্রবেশ করবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তনশীল একটি প্রক্রিয়া। বর্তমানে যেসব সুবিধা ও প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি, তা আগামী ২৫ বছর পর আরও উন্নত হবে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে একপর্যায়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা খাতে শক্তিশালী দেশে পরিণত হবে। এ কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আপডেট করার জন্য, আধুনিক প্রযুক্তির জন্য একটি সঠিক পরিকল্পনা থাকা জরুরি।’
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন