ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটতেই রমনার বটমূলে ভৈরবীতে রাগালাপ দিয়ে ছায়ানটের ১৪৩২ বঙ্গাব্দবরণের সূচনা হয়। রমনার বটমূলে সাজানো মঞ্চে সারিবেঁধে বসেন দেড় শতাধিক শিল্পী। ঠিক সোয়া ৬টায় শুরু হয় ঐতিহাসিক এই বর্ষবরণের ৫৮তম আয়োজন। প্রায় ১০ মিনিট চলে রাগালাপের অমৃত সুরের খেয়া। অতঃপর শুরু হয় গান পর্ব।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ও বাংলাদেশের লোকজ ধারার বেশ কিছু গান এই পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। একক ও সমবেত কণ্ঠের পরিবেশনায় থাকা গানগুলো হলো- তোমার চরণ তলে দিও মোরে ঠাঁই, নতুন প্রাণ দাও, তিমির দুয়ার খোলো, আপানারে দিয়ে রচিলি রে, তুমি প্রভাতের সকরুণ রবি, তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী, ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়, সকল কলুষ তামস হর জয় হোক তব জয়, তোর ভেতরে জাগিয়া কে যে, জগতের নাথ করো পার হে, মোরা সত্যের পরে মন আজি করিবো সমর্পণ, আজি নতুন রতনে ভুষণে যতনে, গগনে প্রলয় মেঘের মেলা, আমার মুক্তির আলোয় আলোয়, আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে, মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়, মৃত্যু নাই নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ, এই বাংলা রবি ঠাকুরের বাংলা কবি নজরুলের, এ বিশ্বমাঝে যেখানে যা সাজে, মন সহজে কি সই হবা, ও আলোর পথযাত্রী, নাচো আর গান গাও তালে তালে ঢোল বাজাও তাকধিনাধিন।
এর ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পীরা কবিতা আবৃত্তি করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অনুষ্ঠানের শেষ হয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ দিয়ে।
ছায়ানটের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাপী যেমন ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, তেমনি এদেশেও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। তবু আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, স্বপ্ন দেখি হাতে হাত রেখে সকলে একসাথে মিলবার, চলবার। বাঙালি জাগবেই, সবাই মিলে সুন্দর দিন কাটানোর সময় ফিরবেই। সার্থক হবেই হবে, মানুষ-দেশ, এ পৃথিবীকে ভালোবেসে চলবার মন্ত্র।’ছায়ানটের এবারের আয়োজনের বার্তা, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। যথারীতি অনুষ্ঠান সাজানো হয় নতুন আলো, প্রকৃতি এবং মানুষকে ভালোবাসবার গান, দেশপ্রেম-মানবপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। সব মিলিয়ে বাঙালি সমাজকে নিয়ে আলোর পথে মুক্তির পথযাত্রী হবার আহ্বান ছিল এবারের পরিবেশনায়। এবারের অনুষ্ঠানসজ্জায় ছিল ৯টি সম্মেলক ও ১২টি একক গান এবং ৩টি পাঠ।
বলা দরকার, ১৯৬৭ সালের পহেলা বৈশাখ রমনা উদ্যানে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়, সেটাই এখন বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ। মানুষের মনে স্বাধিকারের চেতনা জাগানোর স্বপ্ন নিয়ে যে ক’জন মানুষ সেদিন নগরে বর্ষবরণের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাদের মাঝে সনজীদা খাতুন ছিলেন অন্যতম। এবারই প্রথম সেই সনজীদাকে ছাড়া বর্ষবরণ করছে ছায়ানট। গত ২৫ মার্চ তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের অন্যতম দিক লিখিত বক্তব্য কিংবা বিশেষ বার্তা। যা বরাবরই পাঠ করে আসছিলেন সনজীদা খাতুন। এবার ছায়ানটের হয়ে সেই বার্তা পাঠ করেন নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী।তিনি বলেন, ‘মুক্তির অন্বেষায় দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বন্ধুর পথ পরিক্রমায় অর্ধশত বছর পূর্বে বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ঐ যাত্রাপথের নিদর্শন ছরিয়ে রয়েছে। বিশ্বাস লিপিবদ্ধ হয়েছে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতসহ সকল মাধ্যম এবং বিভিন্ন স্থাপনায়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রামে অনন্য মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার আয়োজন। আমরা আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি। যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি, বৃত্তের বিভাজন ভাঙবে। গড়বে উদার, সম্প্রীতি, সহিষ্ণু সমাজ।’
বলা দরকার, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই ছায়ানটের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান হয়েছে; নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে সুরের মূর্ছনা আর আশার বার্তায়। করোনা মহামারির দু’বছর রমনা বটমূলে অনুষ্ঠানটি না হলেও আয়োজনটি করা হয়েছে অন্তর্জালে। রমনা উদ্যান থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী এবারের আয়োজন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল (youtube.com/@chhayanautbd) ও ফেইসবুক পেইজে (facebook.com/chhayanautbd) সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। বিটিভিও সরাসরি সম্প্রচার করেছে অনুষ্ঠানটি।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন