ঢাকা , বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫ , ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​খেয়ে না খেয়ে থাকতেন শরীফ, এখন মাসিক আয় ১০ লাখ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৮-০৭-২০২৫ ০৪:২২:১৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৮-০৭-২০২৫ ০৪:২২:১৬ অপরাহ্ন
​খেয়ে না খেয়ে থাকতেন শরীফ, এখন মাসিক আয় ১০ লাখ টাকা ​ছবি: সংগৃহীত
অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলেন ২০০২ সালে। বয়স তখন মাত্র কিশোর। শুরু হয় জীবন যুদ্ধের কঠিন অধ্যায়। চট্টগ্রামের একটি রঙের দোকানে বিনা বেতনে কাজ করে যাত্রা শুরু করা সেই কিশোর আজ দেশের সফল ফন্ট ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা। তার নাম শরীফ উদ্দিন শিশির। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরক্লার্ক ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকার মৃত মো. শাহজাহান মিস্ত্রির ছেলে শরীফ উদ্দিন শিশির। জন্মসূত্রে সুবর্ণচরের হলেও তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। নদীভাঙনে ১৮ বার নিঃস্ব হওয়া এক পরিবার থেকে উঠে আসা শরীফের জীবন গল্প যেন সংগ্রামের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

জানা গেছে, পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে ২০০২ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে আসেন শরীফ উদ্দিন শিশির। দীর্ঘদিন খেয়ে না খেয়ে বিনা বেতনে অথবা একটা সিঙ্গারা খেয়ে মানুষের চাকরি করেছেন শরীফ উদ্দিন শিশির। ২০০৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের হালিশহরে নিজের প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘শরীফ আর্ট’ গড়ে তোলেন। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠা করেন শরীফ আর্ট স্কুল, শরীফ আইটি। বর্তমানে তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ বাংলা ফন্টভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। যেখানে ২০ জন স্থায়ী কর্মী কর্মরত। বর্তমানে তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার এবং মাসিক আয় প্রায় ১০ লাখ টাকা।

ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকের ছবিতে আকৃষ্ট হয়ে চিত্রাঙ্কনে আগ্রহ জন্মায় শরীফের। শিক্ষক না থাকলেও আত্মপ্রচেষ্টায় রপ্ত করেন চিত্রাঙ্কন ও হাতের লেখা। নিজেই তৈরি করতেন রংতুলি। গ্রামে থাকাকালীন বিভিন্ন ব্যানার ও দেয়ালচিত্র আঁকতেন তিনি। ২০০৬ সাল থেকে নিজ হাতের লেখাকে ফন্টে রূপ দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। যা বাস্তবে রূপ পায় ২০১৮ সালে ভারতের নিলাদ্রী শেখর বালার সহায়তায়। ওই বছর ২ অক্টোবর প্রকাশ করেন তার প্রথম বাংলা ফন্ট—“Shorif Shishir”। ফন্টটি ডিজাইন জগতে দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ইন্টারনেটে বহুল ব্যবহৃত বাংলা ফন্টগুলোর তালিকায় উঠে আসে।

বর্তমানে শরীফ উদ্দিন শিশিরের তৈরি বাংলা ফন্টের সংখ্যা ৪৩টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্রন্টগুলো হলো—শরীফ শিশির, শরীফ পূর্ণী, শরীফ সাবিত, শরীফ জনতা, শরীফ সুবর্ণ, শরীফ মিতালী, শরীফ জেসমিন, শরীফ জ্যোৎস্না, শরীফ সন্দ্বীপ। ফন্ট তৈরির পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে বাংলা ফন্ট ডিজাইন শেখাতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন fontbd.com—বাংলা ভাষার ফন্ট সংগ্রহ ও শেয়ারের অন্যতম বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম। সেখানে রয়েছে শত শত ফ্রি ও প্রিমিয়াম ফন্ট, যা এখন ডিজাইনারদের জন্য এক বিশাল সম্পদ।  বাংলা ভাষা ও লিপির প্রতি ভালোবাসা, আত্মপ্রত্যয় ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ‘ফন্টম্যান’ খ্যাত শরীফ উদ্দিন শিশির গড়ে তুলেছেন একটি ব্যতিক্রমী সফলতার দৃষ্টান্ত। অভিমান থেকে শুরু করা এক যুবকের যাত্রা আজ হাজারো তরুণের প্রেরণার আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

শরীফ উদ্দিন শিশির বলেন, আমি মাদরাসা শিক্ষার্থী ছিলাম। আমি ছোট বেলায় কাপড় পেচিয়ে তুলি বানিয়ে বিভিন্ন ছবি আকতাম। সুবর্ণচরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি হওয়ায় শেখার কোনো জায়গা ছিল না। ২০০২ সালে পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে চট্টগ্রামের হালিশহরে আসি। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। কখনো বিনা বেতনে কাজ, কখনো খেয়ে না খেয়ে কিংবা একটি সিঙ্গারা খেয়ে দিন পার করেছি। স্বপ্ন পূরণের জন্য  ২০০৯ সালে গড়ে তুলি  প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘শরীফ আর্ট’। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠা করেন শরীফ আর্ট স্কুল, shorifart.com, শরীফ আইটি ও fontbd.com। তিনি আরও বলেন, বাংলা ফন্ট জগত নিয়ে আমার অনেক পরিশ্রম রয়েছে।  আমার আর্ট থেকে আমি নিজ হাতে ফন্ট তৈরি করেছি। বর্তমানে আমার ৪৩টি বাংলা ফন্ট আছে। ২০১৮ সালে “Shorif Shishir” ফন্ট দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। আমার ফন্টগুলো এখন ইন্টারনেটে বহুল ব্যবহৃত। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার, মাসিক আয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। আবার কখনো কখনো মাসে ২০ লাখ টাকা করেও আয় হয়। আমার তৈরি fontbd.com এখন বাংলা ফন্টের অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম।  

শরীফের ছাত্র ইমরান হোসাইন রাফিদ বলেন, শরীফ স্যার বাংলাদেশের গ্রাফিক ডিজাইন জগতে এক অবমূল্যায়িত কিংবদন্তি। অল্প টাকার কোর্সেও তিনি এমন মানের শিক্ষা দেন, যা অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে। তার তৈরি ৪৩টি ইউনিক বাংলা ফন্ট অনেক ডিজাইনারের প্রেরণা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবেন। শরীফের ভাই শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ৫ ভাই ৬ বোন। আমাদের ভাই অভিমানে বাড়ি ছেড়ে পরিশ্রমের পথ বেছে নিয়েছিল। আজ সে নিজেকে সফল একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু আমাদের পরিবারের নয়, সে এখন অসংখ্য তরুণের অনুপ্রেরণা। অনেক বেকার যুবক তার কাছে শিখে উদ্যোক্তা হয়ে সফল হয়েছে।

নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ ইসমাঈল  বলেন, পরিশ্রম কখনো ব্যর্থ হয় না। শরীফ উদ্দিনের সফলতার পেছনে আছে আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য মনোবল। এক সময় দিনে মাত্র একটি শিংড়া খেয়ে দিন কাটানো সেই কিশোর আজ দেশের গর্ব। আমরা চাই, তিনি আরও এগিয়ে যাক।

 
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ