ঢাকা , শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫ , ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​রূপপুর চালু হলে বিদ্যুতে ভারতনির্ভরতা কমবে

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ০৫-০৭-২০২৫ ১২:৫০:১৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৫-০৭-২০২৫ ১২:৫০:১৩ অপরাহ্ন
​রূপপুর চালু হলে বিদ্যুতে ভারতনির্ভরতা কমবে ​ছবি: সংগৃহীত
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালুর প্রায় দ্বারপ্রান্তে। রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত এ কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ চালু হলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যোগ করবে নতুন মাত্রা। শুরুতে উৎপাদনে আসবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার প্রথম ইউনিট। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন কেবল সরবরাহই বাড়াবে না, বরং বিদ্যুৎ আমদানিতে কমিয়ে আনবে ভারতনির্ভরতা। সেই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অতিনির্ভরতা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১৫ হাজার থেকে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আর এ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বড় নির্ভরতা রয়েছে ভারতের ওপর। প্রতিবেশী দেশটি থেকে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে, যা দেশের মোট চাহিদার ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর এ বিদ্যুতের বড় অংশই জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। তবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রূপপুরের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা গেলে ভারত থেকে আমদানি বিদ্যুতের ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার খোজিন চলতি বছরের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আনার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এলে আমাদের গ্রিডে বড় ধরনের সক্ষমতা যুক্ত হবে। শুরুতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট যুক্ত হলেও পরবর্তী সময়ে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট হবে। এটা বিরাট সক্ষমতা। এ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পর বিপিডিবি যদি উত্তরাঞ্চলে ব্যবহার করে তাহলে দুটো বিষয় দেখা যেতে পারে—প্রথমত, ওই অঞ্চলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে বড় অংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভরতার বিকল্প উৎস তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে আদানি কিংবা জিটুজির বিদ্যুৎ বিকল্প অপশন হবে। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি তেলের পরিবর্তে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর প্রবল যে চাপ রয়েছে তা কমে আসবে।’

বিপিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশির ভাগই ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলভিত্তিক। আর এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে বিপিডিবির উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে। সে কারণে কম খরচ বিবেচনায় ওই অঞ্চলে ভারতের আদানির পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর বড় নির্ভরতা রয়েছে। কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির। এছাড়া ভারত থেকে জিটুজি (সরকারি ব্যবস্থাপনায়) চুক্তির আওতায় আসছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের বিতর্ক। বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা, এমনকি কয়লার দাম নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতা থাকলেও কোনো সমাধানে যেতে পারেনি বিপিডিবি। উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে আদানির বিকল্প না থাকার কারণেই মূলত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না বলে বিপিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান। এখন রূপপুর উৎপাদনে এলে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সে বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা গেলে আমদানি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমবে বলে মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রায়োরিটির ভিত্তিতে রূপপুর-বগুড়া ও রূপপুর-গোপালগঞ্জে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে অনেক বেশি। ফলে সে ‍বিদ্যুৎ ওদিকে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে বিপিডিবির। আমরা রূপপুরের বিদ্যুৎ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’

রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে মোট চারটি গ্রিড লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো রূপপুর-বগুড়া, রূপপুর-গোপালগঞ্জ, রূপপুর-কালিয়াকৈর ও রূপপুর-বাঘাবাড়ী। ৪০০ কেভি এসব উচ্চক্ষমতার সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে তা সফলভাবে সংযুক্তও করা হয়েছে। কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে এসব লাইনে দেশের উত্তরাঞ্চলে বড় আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।

বিপিবিডির শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রূপপুর উৎপাদনে এলে ভারত থেকে বিদ্যুতের আমদানিনির্ভরতার বিষয়টি বিবেচনাধীন হবে। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় তখন দেশীয় স্বার্থের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। সেই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের বিষয়টিও অগ্রাধিকার পাবে।’

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে ২৭ হাজার ৪২৪ মেগাওয়াট (ইনস্টল ক্যাপাসিটি)। চলতি বছরই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসছে। এ বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হলে দেশে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে সাড়ে ২৮ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। তবে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ নিয়ে এখনো কোনো ক্রয়চুক্তিতে যায়নি বিপিডিবি ও রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)।

রূপপুর চালু হলে গ্রিডে বড় আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভারতের ওপর বিদ্যুতের নির্ভরতা কমবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা ওইভাবে দেখছি না। তবে ওই অঞ্চলে অনেকগুলো জ্বালানি তেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। রূপপুর চালু হলে সেগুলোর উৎপাদন কমে আসবে। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কমে যাবে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। রূপপুরের বিদ্যুৎ নিতে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রস্তুত আছে।’

জানা গেছে, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে আনার জন্য যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে এনপিসিবিএল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে কেন্দ্রটির ফুয়েল লোডিংয়ের যাবতীয় পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ চলছে।

জানতে চাইলে এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাসান বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট-১ এ বছরই চালুর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ৩৬৩ জন জনবল প্রস্তুত করা হয়েছে। ইউনিট-১ ফিজিক্যাল স্টার্টআপ কাজ চলছে। অর্থাৎ ফুয়েল লোডিংয়ের আগে যে ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন সেসব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’

রাশিয়ার অর্থায়নে রূপপুরে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিচ্ছে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রোসাটম। রূপপুরের এ অর্থ ব্যয় নিয়ে যদিও বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। 

সূত্র : বণিক বার্তা

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ