ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (ডিপিডিসি) পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা থামছেই না। আদালতের রায় জ্যেষ্ঠতা মেনে পদোন্নতির পক্ষে থাকলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র হারাচ্ছে মেধাবী প্রকৌশলীদের।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে 'ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সার্ভিস রুলস ২০১৭' পাস হয়। কোম্পানির কর্মকর্তারা বিরোধিতা করলেও তা উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষ 'ইউনিফাইড সার্ভিস রুল' নামে এটা পাস করে। যা সংস্থাটিতে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ উঠে। বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা পদগুলোতে চাকরি করার বয়স ৫৯ বছর থেকে ৬৫ বছর বৃদ্ধি করতেই দ্রুত সার্ভিস রুল পাস করা হয়। এছাড়াও কোম্পানিতে মন্ত্রণালয় থেকে লোকবল পদায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা পূর্বের সার্ভিস রুলে ছিল না।
প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা বলছেন, পদোন্নতি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে 'বিতর্কিত' এই সার্ভিস রুল সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল কোনো এক অজানা কারণে তা করছে না। যার কারণে সংস্থাটিতে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে।
ডিপিডিসির সার্ভিস রুল পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, তিন নম্বর ধারায় রিক্রুটমেন্ট এন্ড প্রমোশন পলিসি এন্ড গাইড লাইনস ৩.৩.৪ এ উল্লেখ রয়েছে-
(a) Promotion of all employees shall be subject to the fulfillment of required period of service as stipulated in the schedule of Recruitment and Promotion and the rating of performance appraisal.
(b) Promotion to the post of Assistant Manager and equivalent shall be subject to the fulfillment of conditions stipulated in the Schedule of Recruitment/ Appointment and the rating of the Performance Appraisal.
(c) Each and every promotion shall be judged through an interview.The company board shall approve the interview board for promotion.
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা জানান, এই সার্ভিস রুল কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা পরিবর্তন করা যাবে না। যাদের জন্য এই সার্ভিস রুল করা তাদেরই যদি কোন কল্যাণ বয়ে না আনে, তবে তা রেখেই বা কী লাভ? সার্ভিস রুল পাস হওয়ার পরও বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিকবার এর বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রকৌশলী-কর্মকর্তাদের অভিমত, শুধুমাত্র বোর্ডের মাধ্যমে সার্ভিস রুলের 3.3.4(c) উপধারা বাদ অথবা সেখানে বিদ্যমান 'shall' বাদ দিয়ে 'may or may not' সংযুক্ত করে দিলেই প্রমোশন-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন সম্ভব।
জানা যায়, ইউনিফাইড সার্ভিস রুলসে ডিপিডিসিতে মন্ত্রণালয় থেকে লোকবল পদায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি ও পকেট ভারী করার জন্য। সে মোতাবেক মৌখিক পরীক্ষা (ভাইবা) নিয়ে প্রমোশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হত। ভাইবা বোর্ডে থাকতেন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। তাঁরা যখন যাকে খুশি তাকে পদোন্নতি দিতেন। পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস এবং ডিপিডিসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান। এঁরা যার কথা বলতেন, তারই পদোন্নতি হয়ে যেত। তাঁদের সুপারিশে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তারাই এখন পায়তারা চালাচ্ছেন।
প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা বলছেন, মেধাবী হওয়া স্বত্ত্বেও জ্যেষ্ঠতা মেনে পদোন্নতি না হওয়ায় কর্মস্থলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হারাচ্ছেন কর্মস্পৃহা। পদোন্নতি না পেয়ে সংক্ষুব্ধরা বিভিন্ন মামলা করছেন। বুয়েটের মেধাবীরা সংস্থায় যোগদান করলেও পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। এতে রাষ্ট্র দিনকে দিন মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রমোশন কমিটির সদস্যদের প্রতিদিনের সম্মানি ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। সম্মানি বেশি পাবার আশায় মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) ৪/৫ দিন লম্বা করা হতো। এই সম্মানির লোভেই প্রমোশন ও নিয়োগ কমিটিতে থাকার জন্য অনেক তদবিরও হতো।
অবসরে চলে যাওয়া এক প্রধান প্রকৌশলী বলেন, আমার আওতায় একই পোস্টে দুইজন ভাইভা দিয়েছেন। অথচ যে প্রার্থী কাজে পারদর্শী এবং যার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) নম্বরও বেশি, তাকে না দিয়ে পদোন্নতি দিতে হয়েছে অন্যজনকে। এর ফলে যোগ্য প্রার্থীটি মনোকষ্টে অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে গেছেন।
হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট — দুই আদালতই জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু এই রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো পদোন্নতি প্রক্রিয়া জটিল ও বিলম্বিত করছেন প্রশাসনের (এইচআর) কিছু কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে পদোন্নতি নিয়ে উপরে বসে আছেন। তারাই কর্তৃপক্ষকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ, 'বিতর্কিত' পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের একাধিক বৈঠকের খবরে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে ডিপিডিসিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সময়মত পদোন্নতি দিলে তাঁদের কাজের দক্ষতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা বৃদ্ধি পায়। শতভাগ পেশিদারিত্ব পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের মত গুরুত্বপূর্ণ খাতের একটি প্রতিষ্ঠানে এসংক্রান্ত জটিলতা খুবই হতাশাজনক। দ্রুত এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করে সংস্থাটিকে ইতিবাচক ধারায় আনার উপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এইচএইচ/এসকে
পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ক্ষোভ বাড়ছে ডিপিডিসিতে
অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
আদালতের রায় মানছে না ডিপিডিসি!
পদ ফাঁকা, তবু নেই পদোন্নতি!
মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি