ঢাকা , বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ , ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিধন্য মন্দির-বাড়ি

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ১১:৩৪:৫৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ১১:৩৪:৫৭ পূর্বাহ্ন
​বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিধন্য মন্দির-বাড়ি ফাইল ছবি
ঈদের ছুটিতে সাহিত্যনুরাগী লোকজনের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি ও শিবমন্দির অঙ্গন। কালের রুদ্ররোষে ফুলেশ্বরী নদী সমতল ভূমিতে একাকার হয়ে গেলেও এখনো টিকে থাকা চন্দ্রাবতীর স্মৃতিধন্য মন্দির-বাড়ি দর্শনার্থীরা দিনমান স্মৃতিচিহ্ন দেখতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেরিয়েছেন। কান পেতে শুনেছেন মৈমনসিংহ-গীতিকাখ্যাত ষোড়শ শতকের রোমান্টিক কবি চন্দ্রাবতী আর তার প্রেমিক জয়চন্দ্রের কবিতা আর অমর প্রেমোপাখ্যান। তবে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রতিশ্রুত সংস্কার-সংরক্ষণ ব্যবস্থা পূরণ না হওয়ায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’-এর পাণ্ডুলিপি ফেরত না আনার আক্ষেপ উত্তরপুরুষ অর্জুন চক্রবর্তীর। ষোড়শ শতকের অর্থাৎ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। এ বিদুষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের পাথুয়াইর গ্রামের কাচারি পাড়ার এক সময়ের খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদীর তীরে কবি দ্বীজ বংশী দাস ভট্টাচার্য ও মাতা সুলোচনার ঘর আলোকিত করে ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেন কবি চন্দ্রাবতী। প্রেম-বিরহের অনেক বিয়োগান্তক কাহিনি সৃষ্টি করে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে ফুলেশ্বরী নদীতীরের মন্দিরে শিব আরাধনায় মগ্ন থেকে দেহত্যাগ করেন তিনি। কালের রুদ্ররোষে এক সময়ের খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদী সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছে কবি চন্দ্রাবতী-দ্বিজ বংশী ভট্টাচার্যের মন্দির-বাড়ি। পুরাকীর্তি হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এসব দেখভাল করছে।

‘দস্যু কেনারাম’ ও ‘মলুয়া’-এর মতো রচনা থাকলেও চন্দ্রাবতী প্রকৃত অর্থে রামায়ণ রচনা করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কেনারাম ও মলুয়া এ দুটি পালাকাব্যই ড. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া স্থান করে নিয়েছে চন্দ্রাবতীর অসমাপ্ত রচনা ‘রামায়ণ’। এ কাব্যটি স্থান পেয়েছে পূর্ববঙ্গ গীতিকায়। চন্দ্রাবতীর নিজের জীবনকাহিনি নিয়েও রচিত হয়েছে আরেকটি পালা-‘চন্দ্রাবতী’। নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ওই পালাটিও ময়মনসিংহ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত করা আছে। লোক সংগ্রাহক চন্দ্র কুমার দে-র সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সহযোগিতায় ড. দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকায় চন্দ্রাবতী কাহিনির সফল উপস্থাপন করতে সমর্থ হন।লোক ঐতিহ্যের ইতিহাসপ্রিয় মানুষ আজও তাই ছুটে আসেন তার বাড়ি ও মন্দিরটি দেখতে।

বাবা দ্বিজবংশী দাশ ভট্টাচার্য ‘মনসা মঙ্গল’ লেখার সময় চন্দ্রাবতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়েছিলেন। নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, তার জীবন-ইতিহাস বড়ই করুণ এবং বিয়োগান্তক। চন্দ্রাবতী একদিকে যেমন ছিলেন সাহিত্য প্রতিভাদীপ্ত নারী, তেমনি ছিলেন পরমা সুন্দরী ও রোমান্টিক কবি। প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবন থেকে চন্দ্রাবতীর হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন জয়ানন্দ নামের সহপাঠী প্রেমিক। অনাথ জয়ানন্দ মাতুলালয়ে থাকতেন। শৈশব থেকেই তিনি চন্দ্রাবতীর খেলার সাথী ও সহপাঠী ছিলেন। কৈশোর উত্তীর্ণ হলে জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতীর সম্পর্ক গভীর প্রেমে গড়ায়।

বাবা দ্বিজবংশী দাশ প্রথমে চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের প্রেমকাহিনি জানতেন না। জানার পর তিনি সানন্দে দুজনের বিয়ের দিনক্ষণও স্থির করেছিলেন। আর তখনই রটনা হতে থাকে চন্দ্রাবতীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও জয়ানন্দ এক মুসলিম নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এমনকি ধর্মান্তরিত হয়ে তাকে বিয়ে করেন। চন্দ্রাবতী এ বিয়োগব্যথা মেনে নিতে পারেননি। এমন বিরহ-অভিমানে তিনি স্থির করেন চির কুমারী থেকে শুদ্ধাচারিণীর মতো শিবপূজায় মনোনিবেশ করে জীবন কাটিয়ে দেবেন। বাবাকে এই ইচ্ছার কথা জানালে তিনি নৌকায় কলকাতা থেকে বিগ্রহ এনে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন।দ্বিজবংশী দাশ ফুলেশ্বরী নদীর তীরে নিজের মন্দিরের অনতিদূরে এক শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। ধ্যানমগ্ন হয়ে বিরহকাতর চন্দ্রাবতী ওই মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। সকাল-বিকাল শিবের পূজা আর রামায়ণ রচনায় নিমগ্ন থাকেন।

একদিন সন্ধ্যায় দরজা বন্ধ করে চন্দ্রাবতী মন্দিরে পূজা করছিলেন। এ সময় আত্মগ্লানি ও অনুশোচনায় দগ্ধ প্রেমিক জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে তখন দেখা করতে এলেন। কিন্তু; অভিমানী চন্দ্রাবতী মন্দিরের দরজা খুললেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে শত অনুনয় বিনয়ের পর ব্যর্থ হয়ে জয়ানন্দ মন্দিরের সামনে বেদিতে মালতী ফুলের আরক্ত রস দিয়ে চার ছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন।একপর্যায়ে চন্দ্রাবতী মন্দিরের কপাট খুলে পূজার ফুল বিসর্জন দিতে গিয়ে দেখেন ফুলেশ্বরী অথৈ জলে ভাসছে প্রেমিক জয়চন্দ্রের প্রাণহীন নিথর দেহ। দেখতে পান মন্দিরের গায়ে সন্ধ্যামালতীর আরক্ত রস দিয়ে লেখা ছড়া কবিতাটিও। এমন ঘটনা দেখার পর বিরহকাতর ক্লান্ত চন্দ্রাবতী দৌড়ে এসে মন্দিরে ঢুকে কপাট আটকিয়ে শিবারাধনায় মগ্ন হন। এমন আরাধনাতে নিমগ্ন অবস্থায়ই চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হয়।

চন্দ্রাবতীর মন্দিরের নির্মাণশৈলীও অত্যন্ত শৈল্পিক। মন্দিরের চারপাশ কারুকার্যময়। মন্দিরটির উচ্চতা ১১ মিটার। উঁচু ভিত্তির ওপর থেকে তিনটি ধাপে ঊর্ধ্বগামী হয়ে সূচ্যগ্র শিখরে সমাপ্ত হয়েছে। মন্দিরের পুরো কাঠামো আট কোনাকৃতির। আটটি কোনার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৭ মিটার। নিচের ধাপ এক কক্ষবিশিষ্ট। কক্ষে যাবার জন্য দরজা রয়েছে। কক্ষের ভেতরে দিকে জানালার মতো সাতটি কুলঙ্গি রয়েছে। প্রত্যেকটি ধাপের চারদিক প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত। দ্বিতীয় ধাপটি নির্মাণ করা হয়েছে সরলরেখায়। প্রত্যেক ধাপের কার্নিশ পদ্মপাপড়িতে আবৃত। চূড়ার শেষপ্রান্তে রয়েছে খাঁজকাটা কারুকাজ। এ ছাড়া কলসাকৃতির চূড়ার শীর্ষে আছে ফাইনিয়েল। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে শিবমূর্তি। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে শিবপূজা হয়।

বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ